নৃপেশ তালুকদার নানু::
ষাটের দশকের পুরোটা সময় ছাত্র আন্দোলন ও কৃষক শ্রমিক জনতার গণতান্ত্রিক অধিকার আদায়ের দাবিতে সোচ্চার ও বলিষ্ঠ কণ্ঠ এবং শহরের একজন পরিচিত মুখ চৌধুরী মনসুর আহমদ গত ১৪ জুন ইহলোক ছেড়ে পরলোক গমন করেন।
তার বর্ণাঢ্য জীবনের আলোকিত বিষয় তথা পারিবারিক দিক নিয়ে বিবৃত করার পূর্বে আমি তাঁর বিদেহী আত্মার শান্তি কামনা করি এবং শোকসন্তপ্ত পরিবারের প্রতি সহমর্মিতা জ্ঞাপন করছি। শ্রদ্ধাভাজন মনসুর ভাইয়ের শিক্ষা জীবনের স্কুলের পাঠ সুনামগঞ্জে শেষ করে সিলেট এমসি কলেজ থেকে আইএ পাস করেন। পরবর্তীতে চট্টগ্রাম থেকে বিএ পাস করেন। স্কুলে পড়া অবস্থায়ই সহপাঠীদের নিয়ে তিনি বিভিন্ন সামাজিক দায়িত্ব পালন তথা যেকোনো অন্যায়-অবিচার দেখলে ঝাঁপিয়ে পড়তেন বিষয়টি মীমাংসার জন্য। পরিবার থেকে তাঁর পড়াশোনায় যাতে মনোযোগ বিনষ্ট না হয় সে জন্যই সুনামগঞ্জ থেকে সিলেটে পাঠানো হয়। কিন্তু সেখানে বৃহত্তর পরিবেশে দাবি আদায়ের আন্দোলনে আরো সচেষ্ট হয়ে পড়েন। সেসময় তার ঘনিষ্ঠ সতীর্থদের মধ্যে শিল্পপতি ইকবাল চৌধুরী, রাজনীতিবিদ গুলজার আহমদ, শিক্ষাবিদ আবু হেনা প্রমুখ ছিলেন। সাথীদের অনেকেই স্ব স্ব ক্ষেত্রে সাফল্যতা অর্জন করেছেন। একই কারণে সিলেট থেকে বিএ পড়ার জন্য ঢাকা না পাঠিয়ে চট্টগ্রামে পড়াশোনার ব্যবস্থা করা হয়। চট্টগ্রামে তাঁর ভগ্নিপতির বাসায় থেকে পড়াশোনা করেছেন। তাঁর বোনজামাই চট্টগ্রাম রেলওয়েতে উচ্চপদস্থ একজন কর্মকর্তা ছিলেন। ষাটের দশকের প্রথম দিকে তিনি বিএ ডিগ্রি লাভ করেন। ছাত্রজীবন থেকেই তাঁর লালিত স্বপ্ন ছিল সাধারণ মানুষের জন্য এবং তাদের ন্যায্য দাবি আদায়ের লক্ষ্যে আন্দোলন-সংগ্রামে সরাসরি জড়িয়ে পড়া। এক কথায় বলা যায় সুযোগ-সুবিধা থাকা সত্ত্বেও উচ্চশিক্ষা না নিয়ে এবং চাকুরির মায়া ত্যাগ করে বাবার আয়ের উপর নির্ভরশীলতায় সার্বক্ষণিক রাজনীতিতে জড়িয়ে পড়েন। মনসুর ভাইয়ের পিতা মৌলভী মফিজ চৌধুরী একজন প্রখ্যাত আইনজীবী ছিলেন। তিনি আসামবেঙ্গল আইনসভার সদস্য, সুনামগঞ্জ পৌরসভার প্রথম দিককার একজন চেয়ারম্যান ছিলেন। ষাটের দশকের রাজনীতিতে তৎকালীন পাকিস্তান আমলে ক্ষমতাসীন মুসলিম লীগের বিরুদ্ধে দেশব্যাপী ন্যাপ, আওয়ামী লীগ, জামায়াতে ইসলামী ও অন্যান্য কয়েকটি রাজনৈতিক দলের সমন্বয়ে ‘সম্মিলিত বিরোধী দল’ নামে একটি প্লাটফর্ম গঠন হয়েছিল। উল্লেখিত জোট কর্তৃক আয়োজিত প্রায় প্রত্যেকটি রাজনৈতিক সভায় মৌলভী মফিজ চৌধুরী সভাপতি হিসেবে দায়িত্ব পালন করতেন। ১৯৬৮-৬৯ইং সনে বার্ধক্যজনিত কারণে তিনি রাজনীতি থেকে অবসর নেন। ভাইদের মধ্যে মনসুর ভাই ছিলেন মধ্যম। বড় ভাই প্রয়াত চৌধুরী মাহবুব আহমদ (সাবেক এডিএম), সরকারি চাকুরি পাওয়ার পূর্বে ন্যাপ (ভাসানী) এর সঙ্গে জড়িত ছিলেন। ছোট ভাই প্রয়াত চৌধুরী মনজুর আহমদ। তিনি কুমিল্লা ভিক্টোরিয়া কলেজ থেকে বিএ পাস করে ঢাকা ইউনিভার্সিটি থেকে এমএ পাস করেন। তিনি ঢাকা বিশ^বিদ্যালয়ের ইকবাল হলে থাকতেন। ওই সময় ছাত্রলীগের দাপটের মধ্যেও ইকবাল হলে তিনি ছাত্র ইউনিয়ন (মেনন) কমিটি গঠন করে ছাত্র নেতৃত্ব দিয়েছিলেন। পরবর্তীতে তিনি কোনো সরকারি চাকুরি না নিয়ে চট্টগ্রামে একটি বড় ইলেক্ট্রিক ম্যানুফ্যাকচারিং কোম্পানিতে প্রশাসনিক উচ্চ পদে দীর্ঘ ৩০ বছর চাকুরি করে সিলেট শহরে স্থায়ী হন। অর্থাৎ ভাইদের মধ্যে সকলেই বাম ধারার রাজনীতির সাথে সরাসরি জড়িত ছিলেন। মনসুর ভাইয়ের একমাত্র চাচা প্রয়াত মুসলিম চৌধুরী সাহেব একজন বিশিষ্ট শিক্ষাবিদ এবং সিলেট শহরে সর্বমহলে একজন শ্রদ্ধাভাজন ব্যক্তিত্ব ছিলেন। তার চাচাতো ভাইয়েরা সবাই উচ্চ শিক্ষিত এবং স্ব স্ব ক্ষেত্রে সুনামের সাথে প্রতিষ্ঠিত। মনসুর ভাইয়ের দুই ছেলে। বড় ছেলেটি অল্প বয়সে হার্টফেল করে মারা যায়। ছোট ছেলেটি ডিসি হিসেবে বর্তমানে গাইবান্ধা জেলায় কর্মরত। বড় ভাই চৌধুরী মাহবুব আহমদ যখন ময়মনসিংহ জেলায় এডিএম হিসেবে কর্মরত ছিলেন সেসময় সুনামগঞ্জ থেকে অনেকেই বিএড পড়ার জন্য ময়মনসিংহ যেতেন। পরিচিত অনেক মহিলা শিক্ষার্থী উনার বাসায় যাতায়াত করতেন এবং তাদের সুযোগ-সুবিধা সব সময় দেখভাল করতেন। উনার স্ত্রী এ ব্যাপারে সহযোগিতা করতেন। ছোট ভাই প্রয়াত চৌধুরী মনজুর আহমদ কুমিল্লায় থাকাকালীন তার সহপাঠী বন্ধু সৈয়দ রেজাউর রহমান বার কাউন্সিলে দীর্ঘদিন ভোটে নির্বাচিত নেতা ছিলেন। আমি শুনেছি স্থানীয় আইনজীবীদের অনেকেই মনজুর আহমদের কল্যাণে তাঁর কাছ থেকে বিভিন্ন বিষয়ে সহায়তা পেয়েছেন। পরিবারের প্রত্যেকটি সদস্যদের মধ্যে মানুষের উপকারের মন-মানসিকতা ছিল। পাকিস্তান আমলে মনসুর ভাইকে প্রথম রাজনীতির মাঠে আমি দেখি মিছিলের অগ্রভাগে অবস্থান নিয়ে স্লোগান দিচ্ছেন প্রেসিডেন্ট নির্বাচনে মিস ফাতেমা জিন্নাহকে ভোট দিতে। তখন মুসলিম লীগ মনোনীত প্রার্থী ছিলেন প্রেসিডেন্ট আয়ূব খান এবং সম্মিলিত বিরোধী দলের প্রার্থী ছিলেন ফাতেমা জিন্নাহ। নির্বাচনে ভোটার ছিলেন পৌরসভা ও ইউনিয়নের মেম্বার, চেয়ারম্যানগণ। যতদূর মনে আছে পূর্ব ও পশ্চিম পাকিস্তান এই দুই প্রদেশে ৪০,০০০ করে সমান ভোটার ছিলেন। ওই নির্বাচনে মুসলিম লীগ প্রার্থী প্রেসিডেন্ট আয়ূব খান পূর্ব পাকিস্তানে প্রায় ৪০০০ হাজার ভোট এবং পশ্চিম পাকিস্তানে ১২০০০ ভোট বেশি পেয়ে নির্বাচিত হয়েছিলেন। তখন থেকেই প্রায় সময়ই সরকার বিরোধী বিভিন্ন ইস্যু নিয়ে পুরাতন কলেজ প্রাঙ্গণে (ট্রাফিক পয়েন্ট) মনসুর ভাইয়ের জ্বালাময়ী বক্তৃতা শোনা যেত। ন্যাপ, কৃষক সমিতি এবং শ্রমিক সংঘের পক্ষে জিন্দাবাদ দিতেন। মনসুর ভাই মাওলানা ভাসানীর অনুসারী এবং সমাজতান্ত্রিক ধ্যান-ধারণা লালন করতেন। ১৯৬৫-৬৬ সালে সমাজতান্ত্রিক দুনিয়া ব্যাপী রুশ ও চীন মতবাদ নিয়ে নিজেদের মধ্যে বিভক্তি দেখা দেয়। শান্তিপূর্ণ উপায়ে সমাজতন্ত্র কায়েম বনাম সশস্ত্র বিপ্লবের মাধ্যমে এ নিয়ে বিতর্ক সৃষ্টি হয়। অন্যান্য দেশের মতো এ দেশেও সমাজতন্ত্রীরা দু’ভাগ হয়ে যায়। এতদিন সমাজতন্ত্রীরা মাওলানা ভাসানীর নেতৃত্বে এক হয়ে কাজ করছিলেন। ১৯৬৭ইং সনে রুশপন্থী ও চীনপন্থী গ্রুপে ন্যাপ দু’ভাগ হয়ে বিভক্তি চূড়ান্ত রূপ নিল। মনসুর ভাই চীনপন্থী হিসেবে সারা জেলায় পরিচিতি লাভ করলেন। তিনি নিজে কোনো পদ-পদবীতে না থেকেও একা সম্পূর্ণ দায়িত্ব নিয়ে দলের কাজ করে গেছেন। পূর্ব পাকিস্তানে প্রধান তিনটি ছাত্র সংগঠন ছিল পূর্ব পাকিস্তান ছাত্রলীগ, পূর্ব পাকিস্তান ছাত্র ইউনিয়ন (চীনপন্থী) ও পূর্ব পাকিস্তান ছাত্র ইউনিয়ন (রুশপন্থী)। ১৯৬৯ইং সনে গণঅভ্যুত্থানে ওই তিন ছাত্র সংগঠন ‘ছাত্র সংগ্রাম পরিষদ’ গঠন করে। এক পর্যায়ে ছাত্র ফেডারেশনের একটি অংশ সংগ্রাম পরিষদে যোগ দেয়। তখন ছাত্র ইউনিয়ন (পিকিংপন্থী) সুনামগঞ্জে গঠন ও বিস্তৃতি লাভের জন্য মনসরুর ভাই একজন অভিভাবক হিসেবে সর্বশক্তি দিয়ে জড়িয়ে পড়েন। প্রয়াত গোলাম রব্বানী ভাই তখন সুনামগঞ্জ কলেজে চতুর্থ বর্ষের ছাত্র এবং কলেজ ক্যাম্পাস তথা সুনামগঞ্জ জেলায় ছাত্রসমাজের কাছে খুবই পরিচিত ও জনপ্রিয় মুখ ছিলেন। তিনি ছাত্র ইউনিয়ন (রুশপন্থী) এর নেতৃত্ব নিয়ে সফলতার শীর্ষে সংগঠনকে দাঁড় করেছিলেন। তাছাড়া ওই ছাত্র সংগঠনের উপর কমরেড বরুণ রায়, গুলজার আহমদ, সুরঞ্জিত সেনগুপ্ত, আলী ইউনুছ প্রমুখ রাজনৈতিক নেতাদের আশীর্বাদ ও সহানুভূতি ছিল। এছাড়াও এর কেন্দ্রীয় নেতৃত্বে ছিলেন সমগ্র পূর্ব পাকিস্তানের অগ্নিকন্যা খ্যাত বেগম মতিয়া চৌধুরী। পরবর্তীতে অবশ্য তিনি অন্য ধারার রাজনীতিতে জড়িয়ে পড়েন। এ অবস্থায় সুনামগঞ্জ জেলায় ছাত্র ইউনিয়ন মতিয়া গ্রুপ জনপ্রিয়তা ও গ্রহণযোগ্যতা লাভ করে। এমন অবস্থায় মনসুর ভাইকে ঢাকায় ডেকে পাঠিয়ে মোহাম্মদ তোয়াহা, কাজী জাফর, হায়দার আকবর খান (রনো) ছাত্র ইউনিয়ন (পিকিংপন্থী) সংগঠনের সুনামগঞ্জে নেতৃত্ব নেয়ার জন্য দায়িত্ব দেয়া হয়। এক কথায় বলা যায়, সংগঠনটিকে শূন্য থেকে দাঁড় করানো। ছাত্র ইউনিয়ন মতিয়া গ্রুপ এখানে কতোটুকু শক্তিশালী উপরে কিছুটা উল্লেখ করা হয়। এমনতর প্রতিকূল অবস্থায় মনসুর ভাই তাদের পারিবারিক শুভাকাক্সিক্ষ ছাত্র, ঘনিষ্ঠ বন্ধুদের ছাত্র আত্মীয় স্বজন, নিজের ছোট ভাই চৌধুরী মনজুর আহমদের বন্ধুমহল এবং তাদের ছাত্র আত্মীয় স্বজন এবং মনসুর ভাইয়ের রাজনীতির সাথে বিশ্বাসী ৩০/৪০ জন ছাত্র নিয়ে জননেতা আলফাত উদ্দিন মোক্তার সাহেবের বাসায় প্রথম এক বৈঠকে মিলিত হন। তিনি তৎকালীন বিশ্ব পরিস্থিতি, দেশের সামগ্রিক অবস্থা, কি করণীয় এসব বিষয়ে নীতিদীর্ঘ আলোচনা করেন। ঐ বৈঠক থেকে উপস্থিত সবাই মনসুর ভাইকে নেতা হিসেবে মেনে তার সংগঠনকে সমর্থন জ্ঞাপন করা হয়। তখন সুনামগঞ্জে ছাত্র ইউনিয়ন দুই গ্রুপই প্রধান সংগঠন ছিল। সংগঠনের বিভক্তির কারণে ঢাকা থেকে প্রায় সময় কেন্দ্রীয় নেতৃবৃন্দ আসতেন। এক কথায় ১৯৬৭-১৯৬৯ইং সনে ছাত্র রাজনীতির উত্তাল সময় সবাই উপভোগ করেছেন। একই সময়ে সুনামগঞ্জ কলেজ ছাত্র সংসদের নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়। এক্ষেত্রে ছাত্র ইউনিয়ন উভয় গ্রুপ প্রতিদ্বন্দ্বিতা করলেও মতিয়া গ্রুপ পুরো প্যানেল জয়ী হয়। তবে মনসুর ভাইয়ের সার্বক্ষণিক সহযোগিতা ও বুদ্ধিমত্তায় শূন্য থেকে ভালো প্রতিদ্বন্দ্বিতায় ছাত্র ইউনিয়ন মেনন গ্রুপ সংগঠনকে নিয়ে আসতে সক্ষম হয়েছিলেন। শহীদ মিনার সংলগ্ন সাধনা ঔষধালয়ে মেনন গ্রুপ ছাত্র সংগঠনের মিলনস্থল ছিল এবং জননেতা আলফাত উদ্দিন মোক্তার সাহেবের বৈঠকখানায় ছাত্র ইউনিয়নের অস্থায়ী কার্যালয় ছিল। প্রতিদিন বিকাল থেকে সন্ধ্যা পর্যন্ত অনেক ছাত্র সেখানে পর্যায়ক্রমে যাতায়াত করতেন। মধ্যমণি থাকতেন মনসুর ভাই। নিয়মিত দেখতাম পরিবারের পকেট কেটে মনসুর ভাই চা, বিস্কুট দিয়ে উপস্থিতদের আপ্যায়ন করাতেন। সাধনা ঔষধালয়ে নেহাৎ আড্ডা দেয়ার জন্য সিনিয়র কবিরাজ মহাশয়কে পরিবার-পরিজন নিয়ে নিজের বাসার সামনে একটি টিনের চৌচালা ঘর তৈরি করে থাকতে দিয়েছিলেন। মনসুর ভাইয়ের মন-মানসিকতা ছিল এ রকমেরই। সুনামগঞ্জের রাজনীতির পাঠে মনসুর ভাইয়ের নাম অবশ্যই উচ্চারিত হবে। [লেখক : সাবেক সদস্য, বাংলাদেশ ছাত্র ইউনিয়ন চীনপন্থী]
নিউজটি আপডেট করেছেন : SunamKantha
রাজনৈতিক ব্যক্তিত্ব মনসুর ভাই স্মরণে
- আপলোড সময় : ৩০-০৭-২০২৫ ১২:০৩:৩৯ পূর্বাহ্ন
- আপডেট সময় : ৩০-০৭-২০২৫ ১২:৩৪:৪৯ পূর্বাহ্ন

কমেন্ট বক্স
সর্বশেষ সংবাদ